ভাগবত পুরাণে কৃষ্ণের প্রাসাদে কুচেলার আগমন নিয়ে একটি মর্মস্পর্শী অধ্যায় আছে। সান্দীপনীর গুরুকুলে কৃষ্ণ এবং কুচেলা সহপাঠী ছিলেন। যখন কৃষ্ণ রাজার ন্যায় জীবনযাপন করছেন, তখন কুচেলা অত্যন্ত দারিদ্রের মধ্যে। কুচেলা কতকটা সাহায্যপ্রার্থী হয়েই পুরাতন বন্ধু কৃষ্ণের কাছে এসেছিলেন, কিন্তু যখন তিনি কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হলেন, তখন আর সেকথা বলতে পারলেননা।
কৃষ্ণ কোনও প্রতিদানের আশা ব্যতীতই কুচেলাকে অনেক কিছু দান করেন। তিনি অনুভব করেছিলেন যে, তাঁর মত একজন উচ্চবিত্ত মানুষের কর্তব্য হল কুচেলার মত দারিদ্রক্লিষ্ট মিত্রের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। তথাপি, তিনি কুচেলাকে সরাসরি কিছু দেননা। তিনি সরাসরি দান করে তাঁর মিত্রকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাননা। তিনি নিঃশব্দে কোনোরকম অকারণ ব্যস্ততা না দেখিয়েই কর্মটি সমাধা করেন। তিনি কুচেলাকে কোনোরকম অস্বস্তিপূর্ণ অবস্থায় ফেলেন না। তাঁর কাছে কোনও প্রতিদানও আশা করেননা। কৃষ্ণের দয়াশীলতা ছিল অতুলনীয় (ভা. পু. ১০.৮০)।
এই ঘটনার সাথে তুলনা করুন কর্ণের সাহায্যার্থে দুর্যোধনের আবির্ভাব। কর্ণের প্রবল পরাক্রম প্রত্যক্ষ ক’রে দুর্যোধন প্রথমেই বুঝেছিলেন যে এমন নির্ভীক যোদ্ধা ভবিষ্যতে কাজে আসবে সন্দেহ নেই। তারপর তিনি খুবই ঘটা ক’রে সকলের সামনে কর্ণকে অঙ্গরাজ্য দান করেন, এমন এক রাজ্য যেখানে খুব সম্ভবত কর্ণ কখনও পদার্পণই করেননি। অতঃপর, কর্ণ কার্যত দুর্যোধনের দাসে পরিণত হন। বন্ধুত্বের এক সম্মানীয় স্থান পেলেও, কর্ণের আচরণ বেশীরভাগ সময়েই একজন বন্ধুর মত না হয়ে বরং একজন স্তাবক বা দাসের মত ছিল। কর্ণ কখনই দুর্যোধনের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেননি। কখনও কোনও যুক্তির অবতারণা করেননি। সর্বদাই তিনি দুর্যোধনের অন্ধ সমর্থক। যেকোনো মহানুভব ব্যক্তিই বলবেন যে কর্ণ ছিলেন দুর্যোধনের ভক্ত। দুর্যোধন কর্ণকে যা দিয়েছিলেন, প্রতিদানে অধিক লাভবান হয়েছেন; বলা বাহুল্য, এটি অত্যন্ত লাভজনক একটি বিনিয়োগ ছিল।
দুই বাল্যবন্ধু দ্রুপদ আর দ্রোণের সম্পর্ক কে কেন্দ্র করে মহাভারতে আরেকটি আকর্ষক অধ্যায় আছে যা আমাদের বর্তমান আলোচনার বিপরীতধর্মী। ছাত্রাবস্থায় দ্রুপদ দ্রোণকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর বহু বছর পর, দারিদ্রক্লিষ্ট দ্রোণ নিরুপায় অবস্থায় দ্রুপদের রাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হন। বাল্যবন্ধুকে সাহায্য করার পরিবর্তে দ্রুপদ দ্রোণকে বলেন যে, বন্ধুত্ব শুধুমাত্র সমকক্ষ ব্যক্তিদের মধ্যেই হয়। শৈশবের দিনগুলোয়, তাঁদের দুজনেরই যোগ্যতা ছিল সমান, তাই তাঁদের বন্ধুত্বও ছিল যুক্তিযুক্ত, কিন্তু এখন দ্রুপদ একজন রাজা এবং দ্রোণ একজন ভিক্ষাজীবী, ফলে এখন তাঁদের বন্ধুত্ব মূল্যহীন। দ্রুপদের এই উত্তর দ্রোণের মনে এতটাই বিরক্তির উদ্রেক করেছিল যে, তিনি এর নিরসন করতে পাণ্ডবদের গুরুদক্ষিণাস্বরূপ দ্রুপদকে বন্দী করে আনতে আদেশ দেন। প্রাণের বন্ধুত্ব শেষে রূপান্তরিত হয় চরম বৈরিতায়।
গীতায় কৃষ্ণ উপহার দেবার সঠিক পন্থা ব্যাখ্যা করেছেন - “কোনরকম প্রতিদানের আশা না করে আপন কর্তব্য ভেবে দান করা উচিৎ এবং তা উৎসর্গ করা উচিৎ সঠিক স্থানকাল বিশেষে এমন এক যোগ্য ব্যক্তিকে, যিনি প্রতিদানে কোনরকম অনুগ্রহ দেখাতে অপারগ” (ভ. গী. ১৭.২০)। এই একই পন্থায় তিনি নিজেও দান করেছেন।
মহাভারতে, আসন্ন যুদ্ধের বাতাবরণে কৃষ্ণের কাছে সাহায্যপ্রার্থী হয়ে অর্জুন এবং দুর্যোধনের আগমন নিয়ে একটি চাতুর্যপূর্ণ অধ্যায় আছে। কৃষ্ণ উভয়কেই প্রসন্ন করেছিলেন। একজনের কাছে তিনি সম্পূর্ণ নিরস্ত্র থাকার অঙ্গীকার ক’রে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। আর আরেকজনকে দান করেছিলেন তাঁর সম্পূর্ণ নারায়ণী সেনা।
বছরের পর বছর ধরে তাঁর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাকে তিনি এমনই একজনের হাতে সঁপে দিলেন, সেই দুর্যোধনের জন্য বিশেষ করে কৃষ্ণের উদ্বেগের কোনও কারণই ছিলনা। কিন্তু তাও দিলেন, কারণ দুর্যোধন সাহায্যভিক্ষা করেছিলেন (ম. ভা. ৫.৭)।
এই বিরাট সেনা দান করে একবারের জন্যও তিনি এই বিষয়ে ভাবেননি বা এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুতাপও করেননি। এমনকি যে পাণ্ডবদের তিনি যুদ্ধজয়ে সাহায্য করেছেন, তাঁদের কাছেও কখনও কোনও আনুকূল্য বা উচ্চ আসনের দাবী করেননি।
গীতায় কৃষ্ণ যে নির্লেপ কর্মের ব্যাখ্যা দেন যে, কর্মফলের চিন্তা না করে কর্মের প্রতি মনঃসংযোগ এবং পৃথিবীর মঙ্গলার্থে কর্মসাধন (ভ. গী. - ২.৪৭-৪৮, ২.৫০, ৩.২০ ইত্যাদি), সেই দর্শনালোকে যখন আমরা কৃষ্ণের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করি, তখন দেখা যায় যে কৃষ্ণের জীবনে কর্মই যোগ, ফলে তাঁর সকল কর্মই নির্লেপ কর্ম। তিনি একাধারে এক যোগী এবং এক সন্ন্যাসী।
ক্রমশ:
মূলরচনা - শতাবধানী ডঃ আর. গণেশ ও হরি রবিকুমারের “ভগবদ-গীতা ইন দ্য লাইফ অফ কৃষ্ণ”
তথ্যসূত্র
ভাগবতপুরাণ (গোরখপুর: গীতা প্রেস)
মহাভারত এবং হরিবংশের (ক্রিটিকাল টেক্স্ট) জটিল সংস্করণ / সমালোচনামূলক সংস্করণ (৫ খণ্ডে). সম্পাদনা - ভি. এস. সুখথংকর ও অন্যান্য (পুনে, ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সিটিউট – ১৯৬৬)
দ্য নিউ ভগবদ্গীতা - কোটি শ্রীকৃষ্ণ এবং হরি রবিকুমার (মেসন: ডব্লিউ. আই. এস. ই. ওয়র্ডস্ ২০১১)