গীতায় কৃষ্ণকে প্রায়শই ভক্তি সম্বন্ধে কথা বলতে লক্ষ্য করা যায়। তিনি যতদূর বলেন - যে রূপে চাও সেই রূপে আন্তরিকভাবে ঈশ্বরের উপাসনা কর ; তোমার বিশ্বাসকে আমি শক্তিপ্রদান করব (ভ.গী. ৭.২১)। কিন্তু একথা কি কৃষ্ণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ? তিনি কি একজন ভক্ত? নাকি একজন দাম্ভিক দেবতা?
মাতাপিতা, গুরুজন, শিক্ষক এবং জ্ঞানীর প্রতি কৃষ্ণের ভক্তি ও আনুগত্য লক্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তিনি যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞকালে উপস্থিত সকল ঋষির চরণধৌত করেছিলেন (ম. ভা. ২.৩০-৩২) – তিনি প্রকৃত নম্রতার অলঙ্কারে ভূষিত ছিলেন, গীতায় তিনি গুণের ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন (ভ.গী. ৬.৪৭)। কিন্তু অন্যান্য দেবদেবীর প্রতি কৃষ্ণের ভক্তি কেমন ছিল ? অনুশাসন পর্বে দেখা যায়, ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে ঋষি ঊপমন্যুর উপাখ্যান শোনাচ্ছেন যিনি কৃষ্ণের কাছে শিবসহস্রনাম (শিবের এক সহস্র নাম) শিখেছিলেন এবং তাঁর কাছেই মন্ত্রটি প্রথম প্রকাশ পায় (ম. ভা. ১৩.১৪-১৭)। ভাগবতপুরাণের একটি আখ্যান অনুসারে, কৃষ্ণকে শিবের উপাসনা করতে এবং একটি যোগ্য পুত্রলাভের আশায় প্রায়শ্চিত্তবিধি পালন করতে দেখা যায় (ভা.পু. ১০.৮৮)। মহাভারতে শান্তিদৌত্য চলাকালীন কৃষ্ণ বলেন, “একজন মানুষ হিসেবে আমার যতটুকু করণীয় আমি করতে পারি, কিন্তু তারপর সমস্তটাই ঈশ্বরের হাতে” (ম.ভা. ৫.৭৭.৪-৫)।
কৃষ্ণ ইন্দ্রের বিরোধী ছিলেন, এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে এবং কৃষ্ণের গোবর্ধন পর্বত উত্তোলন কে তার প্রমাণস্বরূপ দেখা হয় (ভা.পু. ১০.২৪-২৭)। এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে দেখা যায় যে কৃষ্ণ মোটেই ইন্দ্রকে অশ্রদ্ধা করেননা। কৃষ্ণ যজ্ঞাদি করা সমর্থন করতেন, এবং যেকোনো যজ্ঞের অর্ঘ্যের বৃহত্তম ভাগ (প্রয়াজ) ইন্দ্রই পেয়ে থাকেন। গীতায় কৃষ্ণ এও বলেছেন, “দেবতাদিগের মধ্যে আমি ইন্দ্র !” (ভ. গী. ১০.২২)। এছাড়াও, কৃষ্ণের প্রিয়তম মিত্র হলেন ইন্দ্রপুত্র অর্জুন। মূলত, ভাগবতের আখ্যানটি হল কৃষ্ণ যখন ইন্দ্রের মহা আড়ম্বরপূর্ণ উপাসনার বিরোধিতা করছেন তার উপর। কৃষ্ণ উপাসনার বিরোধী নন, কিন্তু তিনি বিরোধিতা করেন জাঁকজমক ও আড়ম্বরের। প্রায় সমস্ত উৎসবেরই উদ্দেশ্য হল মানুষকে একে অপরের নিকটে নিয়ে আসা, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর রূপান্তর ঘটে যায় এবং উৎসব পরিণত হয় এক অপ্রয়োজনীয় আড়ম্বরে।
গীতার দ্বাদশতম অধ্যায়ে কৃষ্ণকে একজন ভক্তের বৈশিষ্ট্যাবলী ব্যক্ত করতে দেখা যায়, কিন্তু সেই রূপকে তিনি একজন জ্ঞানীর প্রলক্ষণ বর্ণনা করেন। তাঁর এই বৈশিষ্ট্যাবলীবর্ণন এই বক্তব্যেরই সমর্থন করে যে, এই ভক্ত এবং জ্ঞানী প্রকৃতপক্ষে অভিন্ন। যখন জ্ঞানী হয়ত পথ খুঁজে নেয় আপন বুদ্ধিমত্তায়, ভক্ত খুঁজে পায় স্বজ্ঞাত স্বভাবে, যে কারণেই শঙ্করার ন্যায় জ্ঞানী এবং তুকারামের ন্যায় ভক্তের মধ্যে এই পরিমাণ মতৈক্য লক্ষ্য করা যায়। বিবেকবোধ এবং নিঃস্বার্থতাই হল একজন জ্ঞানী বা ভক্ত হয়ে ওঠার মূল ভিত্তি।
কৃষ্ণ ছিলেন একাধারে একজন জ্ঞানী এবং একজন ভক্ত। ভগবদ্গীতার ১২.১৩ শ্লোকে উনি যা বলেন, তাঁর নিজের জীবনেও এরই প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি বলেন, ভক্ত সেই, যে “কাউকে ঘৃণা করেনা এবং সকলের প্রতি মিত্রভাবাপন্ন ও দয়াশীল” এবং এই একইভাবে তাঁর নিজের জীবনও অতিবাহিত হয়েছে। এমনকি, যে ব্যাধের হাতে তাঁর প্রাণান্ত হয়, তাকেও কৃষ্ণ অন্তিমমুহূর্তে দয়াশীল হয়ে প্রবোধ দান করেন। তিনি আহত হয়েছেন এবং তাঁর মৃত্যু আসন্ন বুঝেও তিনি ক্রোধান্বিত হননা। এরপর তিনি বলেন যে, একজন ভক্ত “সকল আসক্তি ও ঔদ্ধত্য থেকে মুক্ত” এবং তাঁর নিজের সকল ক্রিয়াকলাপের মধ্যেও সর্বদা নিঃস্বার্থতা বিদ্যমান। পরিশেষে তিনি বলেন যে একজন ভক্ত সেই যে “বেদনা ও সুখের মাঝে ভারসাম্য রেখে চলে এবং ক্ষমাশীলতার আভরণে ভূষিত।” রাজসূয়যজ্ঞকালে তাঁর এই ক্ষমাশীলতার নমুনা দেখতে পাওয়া যায় যখন তিনি অগ্রপূজা গ্রহণ করছেন। যখন শিশুপাল একের পর এক অভিযোগ হেনে চলেছেন কৃষ্ণের উপর এবং এমনকি উপস্থিত বাকি সকলেও তা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে শিশুপালের বিরোধিতা করতে উদ্যত, তখনও তিনি নীরব, স্মিত এবং নির্বিকার। শিশুপাল শততম অভব্যতা অতিক্রম করলে পর, তখন কৃষ্ণ তাঁকে বধ করেন (ম.ভা. ২.৩৩-৪২)। এই ঘটনা গীতার আরেক শ্লোক স্মরণ করায় যেখানে কৃষ্ণ বলছেন যে, একজন ভক্ত “প্রশংসা ও নিন্দার সম্মুখে অভিন্ন, একজন নীরব দর্শক মাত্র” (ভ. গী. ১২.১৯)।
ক্রমশ:
মূলরচনা - শতাবধানী ডঃ আর. গণেশ ও হরি রবিকুমারের “ভগবদ-গীতা ইন দ্য লাইফ অফ কৃষ্ণ”
তথ্যসূত্র
ভাগবতপুরাণ (গোরখপুর: গীতা প্রেস)
মহাভারত এবং হরিবংশের (ক্রিটিকাল টেক্স্ট) জটিল সংস্করণ / সমালোচনামূলক সংস্করণ (৫ খণ্ডে). সম্পাদনা - ভি. এস. সুখথংকর ও অন্যান্য (পুনে, ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সিটিউট – ১৯৬৬)
দ্য নিউ ভগবদ্গীতা - কোটি শ্রীকৃষ্ণ এবং হরি রবিকুমার (মেসন: ডব্লিউ. আই. এস. ই. ওয়র্ডস্ ২০১১)