অগ্নিষোমীয় ব্যুহ হল সৃষ্টির কাঠামো, এক অনন্ত বিন্যাস। ভক্ষক-ভক্ষিতের সম্পর্ককে বেঁধে রাখার এক চিরন্তন প্রতিষ্ঠান। এই বিষয়টি উপনিষদ এবং যোগবাসিষ্ঠে আলোচিত হয়েছে। গীতায় কৃষ্ণ এই বিষয়টি সম্পর্কে বলেন যখন তিনি চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি, শক্তি, প্রাণরস, চিন্তা ইত্যাদির সাথে নিজেকে অভিন্ন রূপে বর্ণনা করেন (ভ. গী. ১৫.১২-১৫)।
‘অগ্নি’ যেখানে ভক্ষকের প্রতীক, ‘সোম’ সেখানে ভক্ষিতের। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অগ্নির জন্য উপযুক্ত পরিমাণে সোমের প্রয়োজন। কৃষ্ণ নিজের মধ্যেও তা দেখতে পান। যেমন, দ্রৌপদীর অক্ষয়পাত্র থেকে এক কণা ভাত খেয়েই তিনি তুষ্ট হন। তিনি বোঝেন যে, সোম দ্বারা অগ্নিকে তুষ্ট করাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, কিন্তু কতটা কম সোম দিয়ে অগ্নিকে প্রশমিত রাখা যায় সেইটিই হল সবচেয়ে কার্যকরী উপলব্ধি।
এমনকি সামাজিক বিষয়েও কৃষ্ণের জ্ঞান অতুলনীয়। বর্ণের সর্বোত্তম এবং সবচেয়ে পরিণত সংজ্ঞাটি সম্ভবত গীতাতেই পাওয়া যায়। বর্ণ হচ্ছে সমাজের সেই পরম্পরাগত চতুর্বিভক্ত শ্রেণীবিন্যাস। কৃষ্ণ বর্ণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, বর্ণ গুণ এবং কর্মের উপর নির্ভর করে; জন্ম, লিঙ্গ বা অন্য কিছুর উপর নয় (ভ. গী. ৪.১৩, ১৮.৪২-৪৪)। স্বধর্মের বিষয়ে আলঙ্কারিকভাবে বলার সময়ে (ভ. গী. ৩.৩৫, ১৮.৪৫-৪৮) তিনি সামাজিক দৃষ্টিকোণের চাইতে বর্ণের ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণের উপর বেশী গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন যে, মানুষের উচিত নিজের সহজাত এবং যা উপভোগ্য, সেইরূপ কর্ম নির্বাচন করা।
ক্ষত্রিয় বংশজাত হয়েও কৃষ্ণের শৈশবের বেশীরভাগটাই কেটেছে বৈশ্যদের (ব্যবসায়ী, কৃষক) সান্নিধ্যে। যুদ্ধ, দুর্বৃত্ত দমন, রাজ্যচালনা ইত্যাদি বহুবিধ ক্ষত্রিয়সুলভ কার্যকলাপ কৃষ্ণকে করতে হয়েছে অনেকবার। তিনি তাঁর সূক্ষ্ম রাজনৈতিক বিচারশক্তি ও পরিকল্পনার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। যখন অর্জুন তাঁকে নিজের সারথি হবার জন্য অনুরোধ করেন, তিনি একবাক্যে সম্মত হন। রথচালনা এবং অশ্বের তত্ত্বাবধান জাতীয় কর্মগুলি মূলত শূদ্রজাতির পেশার সঙ্গে যুক্ত। এই ঘটনার সঙ্গে তুলনা চলে আসে যখন কর্ণের সারথি হবার প্রস্তাবে শল্য অত্যন্ত অপদস্থ বোধ করেন (ম. ভা. ৮.২৩)। এরপর সেই একই কৃষ্ণ গীতার মহৎ সত্যটি ব্যক্ত করেন। তিনি একজন শিক্ষক, একজন দার্শনিক ,এবং একজন তর্কশাস্ত্রবিদ রূপে অবতীর্ণ হন – যেগুলি সাধারণত ব্রাহ্মণদের কর্মের অন্তর্ভুক্ত।
গীতায় কৃষ্ণ খাদ্য, নিদ্রা, অবসর, কর্মের মত জীবনের মৌলিক বিষয়গুলি থেকে আরম্ভ করে শিক্ষকের সান্নিধ্যলাভ বা উপহার প্রদান বা সঠিকভাবে বক্তব্য রাখার পন্থা, এমনকি ব্রহ্মণ্ সম্পর্কিত চরম সত্যের মত বিষয়গুলিকে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন। গীতায় কৃষ্ণের উপস্থাপিত জীবনের বিভিন্ন দিকগুলির প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি নিজেই এক আদর্শরূপে বিরাজমান। কৃষ্ণের অভিজ্ঞতাসিক্ত হওয়ার কারণে গীতা সকলের কাছেই কোনও না কোনওভাবে মূল্যবান।
(ক্রমশ:)
মূলরচনা - শতাবধানী ডঃ আর. গণেশ ও হরি রবিকুমারের “ভগবদ-গীতা ইন দ্য লাইফ অফ কৃষ্ণ”
তথ্যসূত্র
ভাগবতপুরাণ (গোরখপুর: গীতা প্রেস)
মহাভারত এবং হরিবংশের (ক্রিটিকাল টেক্স্ট) জটিল সংস্করণ / সমালোচনামূলক সংস্করণ (৫ খণ্ডে). সম্পাদনা - ভি. এস. সুখথংকর ও অন্যান্য (পুনে, ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সিটিউট – ১৯৬৬)
দ্য নিউ ভগবদ্গীতা - কোটি শ্রীকৃষ্ণ এবং হরি রবিকুমার (মেসন: ডব্লিউ. আই. এস. ই. ওয়র্ডস্ ২০১১)