অর্জুনকে শোক থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করে কৃষ্ণ গীতার সূচনা করেন – “জীবিত বা মৃত, কারোর জন্য অশ্রুপাত করনা” (ভ. গী. ২.১১)। এবং তিনি গীতার পরিসমাপ্তিও করেন অর্জুনকে শোক থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ ক’রে – “আমার উপর বিশ্বাস রাখ। আমি তোমাকে মোক্ষ প্রদান করব। তুমি কেঁদো না” (ভ. গী. ১৮.৬৬)। ক্রন্দন থেকে বিরত থাকার এই দুটি মন্ত্রণার মাঝেই তিনি গীতার সমস্ত শিক্ষাদান করেন। কিন্তু কৃষ্ণ তাঁর নিজের জীবনে কি কখনও অশ্রুপাত করেছেন ? মহাভারতের সমস্ত মহান যোদ্ধারাই কখনও না কখনও অশ্রুপাত করেছেন, কিন্তু কৃষ্ণকে তা করতে কখনও দেখা যায়নি। এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে কৃষ্ণ অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছেন, কিন্তু তা কখনও তাঁকে প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। তাঁর জন্মের সময়ও তিনি নাকি হাসছিলেন। মৃত্যুকালেও তিনি হাসিমুখে প্রস্থান করেন। তিনি পুলক ও প্রশান্তির প্রতীক। তাঁর জীবনে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও অশান্তির আগমন হয়েছে, কিন্তু কখনও তাঁকে মেজাজ হারাতে দেখা যায়নি। তিনি দ্বিধায় পড়েছেন এবং সারাজীবন তার সাথে মোকাবিলাও করেছেন। সেই কারণে, তাঁর এই শিক্ষাদানকে আদর্শবাদ বলা যায়না, এর শিকড় গভীর বাস্তবতায় নিহিত।
গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে কৃষ্ণ ধ্যান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন (ভ. গী. ৬.১০-১৫)। আমরা এই শ্লোকগুলিকে মহাভারতের একটি উপাখ্যানের আলোকে আলোকিত হতে দেখতে পাই। যুদ্ধজয়ের উপরান্তে যুধিষ্ঠির রাজা হতে চলেছেন এবং কৃষ্ণ তখন ডুবে রয়েছেন গভীর চিন্তায়। তাঁর তখন, শরশয্যায় শায়িত মহান যোদ্ধা,সেই ভীষ্মের কথা মনে পড়ছে। ভীষ্ম হলেন তাত্ত্বিক জ্ঞানের এক সুবৃহৎ ভাণ্ডার, তাঁর সারাজীবনের লব্ধ জ্ঞান বৃথাই যাবে যদি তা পরবর্তী প্রজন্ম জানতে না পায়। এই অমূল্য সম্পদ নষ্ট হতে দেওয়া যায়না। তিনি তখন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “ চল, ভীষ্মের নিকট জ্ঞানলাভ করে আসি।” কৃষ্ণ বিজয়োল্লাসে বা যুদ্ধজয়ের পিছনে তাঁর বিচারক্ষমতাসম্পন্ন ভূমিকা নিয়ে সকলের কাছে আদৃত হওয়ার পিছনে কোনও সময় নষ্ট করেননি।
ভীষ্মের কাছে যাবার আগে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের সাথে দেখা করতে এলেন এবং দেখলেন যে কৃষ্ণ তখন গভীর ধ্যানে মগ্ন (ম. ভা. ১২.৪৬)। যুধিষ্ঠির দেখে আশ্চর্য হলেন যে, তাঁর ইন্দ্রিয়ানুভূতি গুলি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে এবং তাঁর সমগ্র সত্ত্বা থেকে এক অপার আনন্দ ও শান্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। শুধু তাঁকে দেখেই অপার শান্তিলাভ করা যায়। তিনি স্থির চিত্ত। তাঁর সমগ্র সত্ত্বায় পরম সুখ নিহিত। তিনি দ্যুতিময়। তিনি সমস্ত কিছুর সাথে মিলেমিশে একাকার। যুধিষ্ঠির বলেন যে, কৃষ্ণ হচ্ছেন সেই প্রদীপের ন্যায় যা বায়ুর নিকট আশ্রয়লাভ করেছে। কোনও ধ্যানমগ্ন ব্যক্তিকে বর্ণনা করতে কৃষ্ণও ঠিক এই একই শব্দগুলি ব্যবহার করেছেন (ভ. গী. ৬.১৯)। কৃষ্ণ তারপর বলেন যে, এই যোগশক্তিই তাঁকে চালিত করে। কৃষ্ণ তাঁর জীবনকে উপভোগ করেছেন এবং তাঁর আশেপাশে অন্যদের জীবনে সুখ বয়ে এনেছেন। তিনি কর্মফলের চিন্তা না করেই জীবনকে আলিঙ্গন করেছেন।
দশম অধ্যায়ে কৃষ্ণ ঈশ্বরকে সর্বোত্তম বলে সম্বোধন করেছেন। যা কিছু সমৃদ্ধ, বিস্ময়কর এবং দৃষ্টান্তমূলক তাকে শ্রদ্ধা জানাতে মনে রাখাই এই উক্তির উদ্দেশ্য। ঈশ্বরের উপস্থিতি সর্বত্র হলেও, মহৎ-এর প্রতিই আমরা বিশেষভাবে শ্রদ্ধাশীল হয়ে থাকি। প্রতিটি নদী জীবনদায়িনী হলেও, যখন আমরা ব্রহ্মপুত্রকে দেখি, বিস্ময়ে অভিভূত হই। সকল পর্বতই আমাদের কাছে সুউচ্চ ও সুবৃহৎ, কিন্তু হিমালয়কে দেখলে আমরা যৎপরোনাস্তি আশ্চর্য হই। অন্যভাবে বলতে গেলে, ‘বিভুতি যোগ’ (ঐশ্বরিক দ্যুতি-র পথ) হল, ‘রস’-এর মাধ্যমে ঈশ্বরের সাথে একাত্ম হওয়ার নিমিত্ত, এক নান্দনিক অভিজ্ঞতা। এ হল, সর্বত্র গুণ চিনতে পারার ক্ষমতা। প্রকৃতি, সংস্কৃতি, অন্তরাত্মা এবং মানুষের মহত্ত্বের কথা কৃষ্ণ বলেছেন। অন্যভাবে দেখতে গেলে, এটি সংগঠিত ধর্মবিশ্বাসের উপর সরাসরি আক্রমণ। অর্থাৎ, ঈশ্বরকে পেতে কোনও ব্যক্তির মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই, ঈশ্বরের উপস্থিতি সর্বত্র। তিনি এই বাণীর পুনরাবৃত্তি করেন যখন বলেন, “ সকল পথ ভুলে দৈবের শরণাপন্ন হও” (ভ. গী. ১৮.৬৬)।
এই কারণেই ভগবদ্গীতা হল গীত। গদ্যও নয়, পদ্যও নয়, গীত। যখন আমরা প্রকৃতই নিজেদের আনন্দে থাকি, আমরা সেই আনন্দে গান গাই। আমরা সুমধুর সঙ্গীতে মেতে উঠি, এবং সেটাই জীবন। গায়ক, গীতি ও শ্রোতা কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
যখন তুমি জন্মেছিলে, কারার প্রাকার ছিল তোমায় ঘিরে
জন্মেই গেলে চলে, রইলনা পিতা-মাতার হাত তব শিরে
শৈশব তব সিক্ত-লালিত, অপঠিতের স্নেহক্রোড়ে
পঠন-পাঠন অসমাপ্ত, তব জীবন জুড়ে।
ত্যাজিতে হয়েছে তোমায়, অসংখ্য বার প্রায়
তব দেশ, তব ভিটামাটি, হায়
যোদ্ধা তুমি লাঞ্ছিত হলে, তব জাতের নীচতায়
জ্ঞাতির বিবাদে, স্ত্রীর অহংকারে, পুত্রগণের অপদার্থতায়।
মহাযুদ্ধে তুমিই শুধু, করনি স্পর্শ অস্ত্র
তব অর্জুনও, যেন অমনোযোগী, অতিসাধারণ ছাত্র
তোমার মহাপ্রয়াণ যেন, অতি তুচ্ছ ঘটনা মাত্র
তথাপি তব স্বরে, কভু মেলেনি বিলাপসূত্র।
ধরণী ছিল তব জন্মের প্রতীক্ষায় রত
দিয়াছ তুমি মৃত্যুকে ফাঁকি কত
রয়েছিলে সদা বীরকর্মে যত
হরিয়াছ নারীহৃদয় শত শত।
হে জগদ্গুরু, তুমি মুকুট রাখ রাজার শিরে
তুমি আপন করেছ প্রত্যেক প্রাণীটিরে
সকল কিছুই ছিল তোমার নীড়ে
তথাপি চির নিরহংকার, তব মনের সাগরতীরে।
(কবিতা – ডঃ আর. গণেশ, অনুবাদ – সায়ন্তন বন্দ্যোপাধ্যায়)
সমাপ্ত
মূলরচনা – শতাবধানী ডঃ আর. গণেশ ও হরি রবিকুমারের “ভগবদ-গীতা ইন দ্য লাইফ অফ কৃষ্ণ”
তথ্যসূত্র
ভাগবতপুরাণ (গোরখপুর: গীতা প্রেস)
মহাভারত এবং হরিবংশের (ক্রিটিকল টেক্স্ট) জটিল সংস্করণ / সমালোচনামূলক সংস্করণ (৫ খণ্ডে). সম্পাদনা - ভি. এস. সুখথংকর ও অন্যান্য (পুনে, ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সিটিউট – ১৯৬৬)
দ্য নিউ ভগবদ্গীতা - কোটি শ্রীকৃষ্ণ এবং হরি রবিকুমার (মেসন: ডব্লিউ. আই. এস. ই. ওয়র্ডস্ ২০১১)