বাগ্মিতা, সততা, বুদ্ধিমত্তা, বৈদগ্ধ্য অথবা প্রত্যুতপন্নমতিত্ব – একজন প্রকৃত কূটনীতিজ্ঞের সকল গুণই কৃষ্ণের মধ্যে উপস্থিত ছিল। তাঁকে একজন মৃদুভাষী রূপে কল্পনা করা যায়। তাঁর বাণী একাধারে সৎ এবং চিত্তগ্রাহী (ভ. গী. ১৭.১৫)। তাঁর বাণী কখনও ভ্রান্ত নয়, বরং অতি বাস্তবিক। তিনি কখনও প্রতিজ্ঞাবিস্মৃত হননি, কখনও প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করেননি। আবার, ধর্মরক্ষার্থে শত প্রতিজ্ঞা পরিত্যাগ করতেও পিছপা নন। কৃষ্ণের ‘ধর্মদৃষ্টি’-তেই (সামগ্রিক সদগুণ উপলব্ধি করার দূরদর্শিতা) গীতা পরিপূর্ণ।
যে যুধিষ্ঠির সত্য ও ধর্মের প্রতীক বলে সুপরিচিত, সেই যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে প্রশ্ন করছেন - “আমি কি রাজসূয়যজ্ঞ সম্পাদনের যোগ্য ?” এবং তিনি কৃষ্ণের দ্বারস্থ হয়েছেন এই কারণেই যে, তিনি নিশ্চিত যে কৃষ্ণ মিথ্যা বলবেন না। যুধিষ্ঠির জানেন যে কৃষ্ণ সর্বদা বাস্তব, সত্য এবং উৎসাহদায়ক কথাই বলে থাকেন। প্রত্যাশিত ভাবেই কৃষ্ণ তাঁকে নিরাশ করেননি। তিনি যুধিষ্ঠিরকে মিষ্টতার মোড়কে তিক্ত সত্য গুলিই ব্যক্ত করেন (ম. ভা. ২.১২-১৩)।
পরবর্তীকালে, কৃষ্ণ যখন দ্বৈতবনে পাণ্ডবদের সঙ্গে মিলিত হন, দ্যূতক্রীড়া কালে তাঁরা যে চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছিলেন, সেই কারণে তাঁদের তিরস্কার করেন। তিনি বলেন, “ নিঃসন্দেহে কৌরবরা মন্দ, কিন্তু তাই বলে তোমাদের হঠকারী হওয়ার কোনও কারণ ছিলনা (ম.ভা. ৩.১৩-১৪)।
গীতায় কৃষ্ণ বলেন, “সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও যন্ত্রণা, লাভ ও ক্ষতি, জয় ও পরাজয় – এই সকলের প্রতি সমান উদ্দীপনা ও প্রচেষ্টা থাকলে তোমার কখনও নিজেকে অপরাধী বলে মনে হবেনা (ভ. গী. ২.৩৮)। যুদ্ধের পূর্বে, এই কৃষ্ণই গিয়েছিলেন শান্তি দৌত্যে। তিনি জানতেন যে, যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। এমনকি, ধৃতরাষ্ট্রের সভায় আসবার পূর্বেই তিনি দ্রৌপদীকে বলেছেন, “চিন্তা করনা ! তোমার সকল শত্রু নাশ হবে। আমার কথার কখনও অন্যথা হবেনা (ম. ভা. ৫.৮০)। তা সত্ত্বেও, তিনি যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন যাতে যুদ্ধ না হয়। তিনি যদিও ভালমতই জানেন, ফলাফল কী হতে চলেছে, তাও একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে পিছপা হননি। ফলাফল কী হতে চলেছে সেটা জানেন বলে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র তিনি নন (ভ. গী. ১৮.১৩-১৬ তে তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে এই ঘটনা মিলিয়ে দেখুন, যেখানে তিনি বলছেন, যেকোনো কর্মের ফল পাঁচটি কারণের উপর নির্ভর করে - ব্যক্তি, পরিস্থিতি, সংস্থান, সংস্থান ব্যবহারের প্রকৃতি এবং অজ্ঞাত কারণ )।
শান্তিদূত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রের সভায় উপস্থিত হয়ে (ম. ভা. ৫.৯৩) প্রথমেই কৃষ্ণ ‘সাম’ নীতি অবলম্বন করলেন, অর্থাৎ, পুনর্মিলন এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ বার্তালাপের মাধ্যমে যুক্তিসম্মত ভাবে সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা করলেন। তিনি বললেন, পাণ্ডবরা ইতিমধ্যে তেরটা বছর কঠিন সংগ্রামে অতিবাহিত করেছে, এবার ওঁদের যা প্রাপ্য তা ন্যায্য ভাবে ফিরে পাওয়া উচিৎ। যখন এই নীতি কাজে এলনা, তখন কৃষ্ণ ‘দান’ নীতি প্রয়োগ করলেন, অর্থাৎ, বস্তুবিশেষের লোভ দেখিয়ে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন, “রাজ্যের কথা ভুলে যান। পাণ্ডবদের পাঁচটি মাত্র গ্রাম দিন, অথবা অন্তত একটি গ্রাম।” দুর্যোধন সেই ভূমি দিতেও অস্বীকার করলেন (এমনকি সূচাগ্র মেদিনী ও নয়)। তখন কৃষ্ণ ‘ভেদ’ নীতির আশ্রয় নিলেন, অর্থাৎ, বিভিন্ন পদমর্যাদার মানুষদের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলেন। তিনি ভীষ্ম ও দ্রোণকে অধর্মের পক্ষপাতিত্ব করার জন্য দোষারোপ করলেন। তারপর তিনি কর্ণকে আলাদাভাবে ডেকে তাঁর জন্মরহস্য বলে দিলেন, যাতে কর্ণকে প্রলুব্ধ করে কৌরবদের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় ( ম. ভা. ৫.১৩৮-১৪১)। রাজনীতির প্রতিটি পদক্ষেপে ‘সাম’, ‘দান’ ও ‘ভেদ’ নীতির সাহায্যে যতদূর সম্ভব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা তিনি করেছেন। শেষটায় যখন এই তিনটি নীতিই বিফল হল, তখন তিনি ‘দণ্ড’ নীতি অবলম্বন করলেন, অর্থাৎ, শাস্তি এবং এই ক্ষেত্রে, যুদ্ধ। এমনকি সেখানেও তিনি যুদ্ধকে পৌঁছে দিলেন এক যৌক্তিক পরিসমাপ্তিতে (ভ. গী. ১০.৩৮)।
ক্রমশ:
মূলরচনা - শতাবধানী ডঃ আর. গণেশ ও হরি রবিকুমারের “ভগবদ-গীতা ইন দ্য লাইফ অফ কৃষ্ণ”
তথ্যসূত্র
ভাগবতপুরাণ (গোরখপুর: গীতা প্রেস)
মহাভারত এবং হরিবংশের (ক্রিটিকাল টেক্স্ট) জটিল সংস্করণ / সমালোচনামূলক সংস্করণ (৫ খণ্ডে). সম্পাদনা - ভি. এস. সুখথংকর ও অন্যান্য (পুনে, ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সিটিউট – ১৯৬৬)
দ্য নিউ ভগবদ্গীতা - কোটি শ্রীকৃষ্ণ এবং হরি রবিকুমার (মেসন: ডব্লিউ. আই. এস. ই. ওয়র্ডস্ ২০১১)