কৃষ্ণ যখন অনাসক্তি এবং তৃপ্তি নামক বৈশিষ্ট্যগুলির প্রশস্তি করেন, তখন তিনি কঠোর পরিশ্রমের উপরেও গুরুত্ব আরোপ করেন। স্ববিরোধী যৌক্তিকতার ঝুঁকি নিয়েও কৃষ্ণ গীতায় বলেন, আমি সমস্ত কিছুই লাভ করেছি, তথাপি আমি কর্মে রত (ভ. গী. ৩.২২)। আমি যদি অক্লান্ত কর্মে অসমর্থ হই, তাহলে এই উদাহরণ অনুসরণ করে মনুষ্যজাতি অচলাবস্থায় স্থিত হবে (ভ. গী. ৩.২৩)। যদি আমি কর্ম না করি, তাহলে এই পৃথিবী ধ্বংস হবে, এবং এই অনাসৃষ্টির জন্য দায়ী থাকব আমি (ভ. গী. ৩.২৪)।
তাঁর একথা বলার কারণ কী ? কৃষ্ণ জানেন যে, তিনি যদি কিছু না করেন, ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর হারানোর কিছুই নেই। তিনি যদি নিজকর্ম করেন, তাহলেও ব্যক্তিগত লাভের কোনও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তিনি যদি কিছু না করেন, তবে পৃথিবীর অবক্ষয় অবধারিত। এই কথার তাৎপর্য হচ্ছে, প্রাথমিক কর্তব্য পালনের পরিসরে যদি কোনও তাৎক্ষণিক বা সামান্য লাভের সম্ভাবনা নাও থাকে, তবুও আমাদের তা পালন করা উচিৎ।কারণ এর ফলেই ভবিষ্যতের মহাবিশ্ব টিকে থাকবে। এই কারণেই কৃষ্ণ বারংবার অর্জুনকে আলস্য ত্যাগ করতে বলেছেন (ভ. গী. ২.৪৭, ৩.৮, ১৮.২৮ ইত্যাদি)।
কৃষ্ণের ব্যক্তিগত জীবন প্রায়শই নানান উত্থান-পতনের সম্মুখীন হয়েছে। তিনি একস্থানে কখনও বেশীদিন থাকেননি। তাঁর নিজের রাজত্বে বা তিনি কোনওভাবে যুক্ত ছিলেন এমন কোনও রাজ্যে কখনও একসঙ্গে বেশীদিন শান্তি বিরাজ করেনি। কোনও না কোনও সমস্যা লেগেই থাকত। কিন্তু একবারের জন্যও তিনি তাঁর অন্তরের সহিষ্ণুতা হারাননি। প্রবল অনাসৃষ্টির মধ্যেও তাঁর সম্পূর্ণরূপে নীরব ও আত্মসংযত থাকার ক্ষমতা ছিল। তিনি কদাচিৎ নম্রতা পরিত্যাগ করেছেন এবং সততই জনকল্যাণের প্রতি যত্নবান হয়েছেন। তাঁর মৃদুহাস্য প্রাণবন্ত করেছে অনেক হৃদয়কে। তিনি চিত্তের যে কঠোর সংযমের কথা বলেন (তপো মানসম) - “নীরবতা, মনের প্রশান্তি, আত্মসংযম, ভদ্রতা এবং ভাবনা ও সত্ত্বার বিশুদ্ধতা” (ভ. গী. ১৭.১৬), তাঁর নিজের জীবনই এর এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি তপস্যা করেছেন শরীর, বাক ও চিত্তের। তাঁর জীবন এক দীর্ঘ তপস্যা যা করা হয়নি হিমালয়ের কোনও গুহায় বা দ্বৈতবনে; নানান কার্যকলাপের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেও তিনি সেই অবিচল-ই রয়ে গেলেন (ভ. গী. ৪.১৮-২৩)।
যখন যুদ্ধের ছায়া দীর্ঘ হয়ে এল, বলরাম কার পক্ষে থাকা উচিৎ স্থির করতে না পেরে তীর্থযাত্রায় চলে গেলেন। তিনি নিরপেক্ষ হলেন কোনও যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে নয়, হলেন তাঁর অন্তরের এক উভয়সঙ্কটের সমাধান করতে পারেননি বলে। কৃষ্ণের সে সঙ্কট ছিলনা। তাঁর কাছে যুদ্ধক্ষেত্র এক রক্তের তীর্থক্ষেত্র। সেই রক্তক্ষেত্রের বীভৎসতা ও মৃত্যুর মাঝেও তিনি প্রশান্ত। তিনি বিচ্ছিন্ন, অনুদ্বিগ্ন ও অমলিন। তিনি থাকতে পারেন যোগসাধনার নিরবচ্ছিন্নতায় (ভ. গী. ৫.২৩)। সেই মৃত্যুক্ষেত্রে তিনি নিরন্তর উপদেশ দেন জীবনের।
কোনও অস্ত্রধারণ না করে তিনি পরিণত হন নায়কে। এর কারণ তিনি যা করেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ ছিল কিনা তা নয়, বরং কীভাবে করেছেন সেইটা। এই ঘটনা গীতার বাণীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় যখন তিনি বলেন - “কর্মের প্রতি সমর্পিত ব্যক্তিই সিদ্ধি লাভ করেন” (ভ. গী. ১৮.৪৫)।
(ক্রমশ:)
মূলরচনা - শতাবধানী ডঃ আর. গণেশ ও হরি রবিকুমারের “ভগবদ-গীতা ইন দ্য লাইফ অফ কৃষ্ণ”
তথ্যসূত্র
ভাগবতপুরাণ (গোরখপুর: গীতা প্রেস)
মহাভারত এবং হরিবংশের (ক্রিটিকাল টেক্স্ট) জটিল সংস্করণ / সমালোচনামূলক সংস্করণ (৫ খণ্ডে). সম্পাদনা - ভি. এস. সুখথংকর ও অন্যান্য (পুনে, ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সিটিউট – ১৯৬৬)
দ্য নিউ ভগবদ্গীতা - কোটি শ্রীকৃষ্ণ এবং হরি রবিকুমার (মেসন: ডব্লিউ. আই. এস. ই. ওয়র্ডস্ ২০১১)