গীতার মূল উদ্দেশ্য ছিল অর্জুনকে যুদ্ধে সম্মত করিয়ে শত্রুনিধন। কৃষ্ণ তাঁর বাক্যে কোনরকম জড়তা না রেখে অর্জুনকে অগ্রসর হয়ে প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হওয়ার কথা বলেন। অর্জুনের মনে এই প্রত্যয় আনয়নের পথে তিনি নানাবিধ যুক্তিজাল বিস্তার করেছেন (ভ. গী. ২.৩১-৩৩, ১১.৩৪)। কিন্তু এগুলি কোনও শূন্যগর্ভ উপদেশাবলী নয়। কৃষ্ণ নিজেও প্রচুর প্রাণনাশ করেছেন। তিনি নিজেও নিজেরই আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করেছেন। তিনি নিজের মাতুল কংসকে বধ করেছেন কারণ কংস একজন ধর্মভ্রষ্ট অত্যাচারী শাসকে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি পূতনা (ভ.পু. ১০.৬), শকটাসুর (ভ.পু. ১০.৭), অঘাসুর (ভ.পু. ১০.১২), ধেনুকাসুর (ভ.পু. ১০.১৫), প্রলম্বাসুর (ভ.পু. ১০.১৮), কেশী (ভ.পু. ১০.৩৭) ইত্যাদির ন্যায় অনেক দুর্বৃত্ত বধ করেছেন। কৃষ্ণ নিজেও অনেক যুদ্ধে রত হয়েছেন।
কৃষ্ণের জীবনদর্শন গীতায় উল্লিখিত এক প্রকৃত ঋষির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ – একজন স্থিতধী তিনিই যিনি কোনও প্রতিকূলতায় বিচলিত হননা; যিনি সুখভোগে নিঃস্পৃহ; যিনি কোনওরকমের আবেশ, শঙ্কা বা ক্রোধ সম্পর্কে অনুদ্বিগ্ন (ভ. গী. ২.৫৬)। কৃষ্ণ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে না কখনও কোনও প্রতিকূলতায় বিচলিত হয়েছেন, না কখনও সুখভোগের জন্য লালায়িত হয়েছেন। তিনি ছিলেন অসমসাহসী। অনেকবারই তিনি কোনও পুনর্বিবেচনা ছাড়াই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। যখনই তিনি বুঝতে পারলেন যে কালিয়ানাগ বৃন্দাবনের সমস্ত জল বিষাক্ত করে তুলেছে, তিনি মুহূর্তমধ্যে নদীতে ঝাঁপ দেন এবং সর্পদমনে উদ্যত হন।
কৃষ্ণ তাঁর জীবনে বিবেচিত এবং অবিবেচিত দুই প্রকার ঝুঁকিই নিয়েছেন। ‘সাহস’ শব্দটি কৃষ্ণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপযুক্তভাবে প্রযোজ্য। ‘সাহস’ শব্দের অর্থ শুধু নির্ভীকতা নয়, এর অর্থ হল ঝুঁকি, বীরত্ব, অভিযান – সুযোগের সদ্ব্যবহারের দৃঢ় মানসিকতা। সারাজীবন অগণিত ঝুঁকি নেওয়া কৃষ্ণ অর্জুনকে সান্ত্বনা দেন এই বলে যে, ভয়ের তো কোনও কারণই নেই। আসলে তিনি বলতে চাইছেন যে, ঝুঁকি একটা নিয়েই দেখনা! যদি সফল হও, বিজয়ী হয়ে বিরাট রাজত্ব ভোগ কর। আর সবচেয়ে খারাপ যা হতে পারে তা হল মৃত্যু। তোমার স্বর্গলাভ হবে (ভ. গী. ২.৩৭)। স্বর্গলাভ হলে সেখানে পুনরায় নতুন সুযোগ পাবে। আরেকটি জন্ম। আরেকটি জীবন। আরেকটি সুযোগ। কোনও চিন্তার কারণই নেই (ভ. গী. ৪.৫)।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, কৃষ্ণ কি একজন শীতল মস্তিষ্কের হত্যাকারী যিনি মানসিকভাবে বিষাদগ্রস্ত এক মিত্রকে তাঁর নিজেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করতে বলছেন? এমতাবস্থায় এইসকল হত্যার পিছনে কৃষ্ণের অভিপ্রায় কী তা খুঁটিয়ে অনুসন্ধান করতে হবে। কংসবধের ফলে কৃষ্ণ কি কোনওভাবে লাভবান হয়েছিলেন? এই হত্যা তিনি কি লালসা বা ক্রোধের বশে করেছিলেন ? অথবা নাকি এর পিছনে ক্রিয়া করেছিল তীব্র কোনও আবেগ? কংসবধের পরবর্তী কালে, সমগ্র যাদবগোষ্ঠী কৃষ্ণের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে (ভা.পু ১০.৪৪)। কিন্তু কৃষ্ণ নিজে রাজ্যগ্রহণ না করে উগ্রসেনকে (কংসের পিতা, কৃষ্ণের মাতামহ) কারাগার থেকে মুক্ত ক’রে (কংস তাঁর পিতাকে সিংহাসনচ্যুত ক’রে কারাগারে বন্দী করেছিলেন) এই দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন (ভা.পু ১০.৪৫)। এরপর উগ্রসেন কিছুকাল যাবত রাজ্যশাসন করেছিলেন, কিন্তু একসময় তা যখন আর সম্ভবপর হয়ে উঠলনা, তখনও কিন্তু কৃষ্ণ রাজ্যের উপর কোনরকম অধিকার দাবী করেননি। তিনি অন্য এক ব্যক্তির উপর রাজ্যশাসনের ভার ছেড়ে দেন।
কৃষ্ণ কোনও যুদ্ধকামী ব্যক্তি ছিলেন না, একইসঙ্গে তিনি স্থূলবুদ্ধিসম্পন্নও ছিলেননা। তিনি সর্বদা শান্তিকামী ছিলেন, কিন্তু তাই বলে তাঁর কখনও যুদ্ধভীতি ছিলনা। মহাভারতে বিদুরের গৃহে বসবাসকালীন কৃষ্ণের একদিনের কার্যাবলীর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায়। প্রাতঃকালে উঠে, প্রার্থনাদি সম্পন্ন করে, কৃষ্ণ সর্ব অস্ত্রে সুসজ্জিত হলেন, যদিও তিনি শান্তিপ্রস্তাব নিয়ে যাওয়ারই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন (ম. ভা. ৫.৮১)।
ক্রমশ:
মূলরচনা - শতাবধানী ডঃ আর. গণেশ ও হরি রবিকুমারের “ভগবদ-গীতা ইন দ্য লাইফ অফ কৃষ্ণ”
তথ্যসূত্র
ভাগবতপুরাণ (গোরখপুর: গীতা প্রেস)
মহাভারত এবং হরিবংশের (ক্রিটিকাল টেক্স্ট) জটিল সংস্করণ / সমালোচনামূলক সংস্করণ (৫ খণ্ডে). সম্পাদনা - ভি. এস. সুখথংকর ও অন্যান্য (পুনে, ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সিটিউট – ১৯৬৬)
দ্য নিউ ভগবদ্গীতা - কোটি শ্রীকৃষ্ণ এবং হরি রবিকুমার (মেসন: ডব্লিউ. আই. এস. ই. ওয়র্ডস্ ২০১১)