আমাদের অনেকের কাছেই কৃষ্ণ হলেন হিন্দুধর্মাদর্শের প্রতীক। তাঁর প্রতিটি চিন্তাধারায়, বাণীতে ও কর্মে হিন্দুমতাদর্শ প্রতিফলিত হয়। তাই এতে এমন কিছু আশ্চর্য লাগেনা, যখন দেখা যায় যে, ভারতযুদ্ধকালীন অর্জুনকে প্রদত্ত তাঁর পরামর্শ গুলি হিন্দু-ভাবনার সর্বশ্রেষ্ঠ সারকথা রূপে পূজিত হয়। ভগবদ্গীতার বর্তমান রূপ-টির প্রতিটি শব্দই যে কৃষ্ণ কর্তৃক উচ্চারিত হয়েছিল, তা আজ জোর দিয়ে বলা না গেলেও, খুব সম্ভবত এটাই মনে হয় যে, অন্তত গীতার মূল সার-টি কৃষ্ণেরই বাণী। আমরা সকলেই কখনও না কখনও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি, যেখানে কোনও এক হতাশাগ্রস্ত বন্ধু পরামর্শ আশা করেছে। এমতাবস্থায় আমাদের সবচেয়ে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হল, নিজ-জীবন হতে অভিজ্ঞতা ও অন্তরদৃষ্টি নিয়ে তাকে সান্ত্বনাপ্রদান। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধপ্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণ খুব সম্ভবত সেটাই করেছিলেন বলে মনে হয়। যদি কোনও সন্দেহের অবকাশ থেকে থাকে, তবে তা তখনই দূরীভূত হবে যখন আমরা গীতাকে পুনরায় কৃষ্ণের জীবনালোকে প্রত্যক্ষ করব।
কৃষ্ণের জীবনের একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরতে, আমরা মূলতঃ এই চারটি গ্রন্থের সূত্র অনুসরণ করব- মহাভারত, হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ এবং ভাগবতপুরাণ। এই গ্রন্থগুলির রচনাকাল ভিন্ন হলেও, গ্রন্থগুলিতে কৃষ্ণের জীবনের সঙ্গে জড়িত ঘটনা ও কাহিনীগুলির মধ্যে বিশেষ কোনও বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়না। কৃষ্ণ কোনও ঐতিহাসিক চরিত্র কিনা তা এখানে প্রসঙ্গ বহির্ভূত হলেও, যে বিষয়টি এখানে সুস্পষ্ট সেটি হল, বাণীতে ও কীর্তিতে তাঁর সমান অবস্থান ও পারদর্শিতা।
গীতার বাণীগুলি কৃষ্ণের আত্মজ্ঞান থেকে উত্থিত হলেও, সেভাবে দেখতে গেলে, তিনি কখনই এর কৃতিত্ব দাবী করেননি। এমনকি যখন কৃষ্ণ বলছেন যে, তিনি প্রথমে বিবস্বত-কে (ভ.গী. ৪.১) এই জ্ঞান প্রদান করেন, তখনও কিন্তু এর কৃতিত্ব কৃষ্ণের উপর বর্তায় না, বরং বর্তায় এই বাণীর সর্বসময়োপযোগিতার উপর। কৃষ্ণ শ্রদ্ধা করেন বংশপরম্পরায় বাহিত তাঁর সেই নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্যকে। এমন সময় আসে যখন জীবন দিগভ্রষ্ট হয় (ভ.গী. ৪.২), কিন্তু যে প্রকৃত সত্যান্বেষী সে ঠিক জ্ঞানের আলোকে পথ খুঁজে নেয়। এছাড়াও, কৃষ্ণকে অনেকবারই বেদমাহাত্ম্য স্বীকার করতেও দেখা যায় (ভ.গী. ২.৪৫, ৭.৮, ৮.১১, ৯.১৭, ১০.২২, ১৩.৪, ১৫.১৫ ইত্যাদি)।
একই সঙ্গে, মাত্রাতিরিক্ত বেদানুসরণের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও তাঁকে বলতে শোনা যায়। তিনি অর্জুনকে সম্পূর্ণরূপে একজন আচারপরায়ণতাবাদীতে রূপান্তরিত হবার বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক করেন (ভ.গী. ২.৪২-৪৬)।
সমস্ত দেবদেবী ও তাঁদের অবতারদের মধ্যে কেবলমাত্র কৃষ্ণই ‘আচার্য’-রূপে বর্ণিত হয়েছেন। তিনি শুধু ‘গীতাচার্য’ নন, তিনি ‘জগদ্গুরু’ ও বটে। ‘আচার্য’ একটি জ্ঞানগর্ভ শব্দ। যেকোনো ব্যক্তিই কোনও বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষালাভ ক’রে, শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন। এই অবস্থায় তাঁকে শিক্ষক বলা যেতে পারে, ‘আচার্য’ নয়। ‘আচার্য’ তিনিই, যাঁর কাছে শিক্ষাই জীবন : “একমাত্র সেই ব্যক্তিকেই আচার্য বলা সম্ভব, যিনি সর্বশাস্ত্রজ্ঞ এবং অর্জিত শিক্ষানুসরণেই জীবন অতিবাহিত করে থাকেন” (আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.২.৬.১৩)।
আচার্য হবার পথে শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যাই যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন জ্ঞান-অর্জন (‘প্রাপ্তি’, ‘সংগ্রহ’), শিক্ষানীতির ব্যবহার (‘পদ্ধতি’, ‘ব্যবস্থাপনা’) ও বাণী ব্যবহারে নৈপুণ্য (‘জীবনান্বয়’, ‘অনুষ্ঠান’)। একজন আচার্যের বাণীকে সত্যরূপে মেনে নেওয়ার এগুলিই হ’ল মূল কারণ। আচার্যের বাণী সত্যই মূল্যবান।
কৃষ্ণ হলেন এমনই এক আচার্য এবং আমরা এই রচনায় ক্রমেই দেখব কীভাবে তাঁর বাণী ও জীবন একে অপরের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। একটি সতর্কীকরণ এখানে আবশ্যক। আমরা ধরে নেব যে পাঠকের ভগবদ্গীতা সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞান রয়েছে এবং তিনি কৃষ্ণের জীবন সম্পর্কে কিছুটা হলেও অবগত।
ক্রমশঃ...
মূলরচনা - শতাবধানী ডঃ আর. গণেশ ও হরি রবিকুমারের “ভগবদ-গীতা ইন দি লাইফ অফ কৃষ্ণ.”
তথ্যসূত্র
ভাগবতপুরাণ (গোরখপুর: গীতা প্রেস)
মহাভারত এবং হরিবংশের (ক্রিটিকল টেক্স্ট) জটিল সংস্করণ / সমালোচনামূলক সংস্করণ (৫ খণ্ডে). সম্পাদনা - ভি. এস. সুখথংকর ও অন্যান্য (পুনে, ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সিটিউট – ১৯৬৬)
দ্য নিউ ভগবদ্গীতা - কোটি শ্রীকৃষ্ণ এবং হরি রবিকুমার (মেসন: ডব্লিউ. আই. এস. ই. ওয়র্ডস্ ২০১১)