এমন কিছু মানুষ থাকেন যাঁদের বয়সের সাথে পূর্ণতা লাভ করার প্রয়োজন পড়েনা, জন্মের সাথে সাথেই যাঁরা সম্পূর্ণ, আত্মজ্ঞানে পরিপূর্ণ। আন্তর বিবর্তন ও মানসিক বৃদ্ধি তাঁদের নিষ্প্রয়োজন, কারণ তাঁরা ইতিমধ্যেই বিবর্তিত। কৃষ্ণ হলেন তাঁদেরই একজন। শৈশবাবস্থার কৃষ্ণলীলা আমাদের সবিস্তারে পরিচিত হলেও, তাঁর তৎকালীন চিন্তাধারা আমাদের অবগত নয়। আমরা যেটুকু বুঝতে পারি সেটা হচ্ছে, তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি শৈশবাবস্থা থেকেই সকল উত্থান-পতন কে জীবনের অঙ্গ হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। ভালমন্দ সমেত জীবনকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন (ভ.গী. ২.৫০)।
ভাগবতপুরাণের একটি বিশেষ অধ্যায় আছে, যেখানে কৃষ্ণের সহচরেরা তাঁর কাছে জীবনের উপদেশ প্রার্থনা করছে। তিনি তৎক্ষণাৎ আশপাশের বৃক্ষরাজির দিকে তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ ক'রে বলছেন (ভা.পু. ১০.২২.৩২ - ৩৫) -
পশ্যতৈতান্ মহাভাগান্
পরার্থৈকান্ত জীবিতান্।
বাতবর্ষাতপহিমান্
সহন্তো বারযন্তি নঃ॥৩২
চেয়ে দেখ এই সৌভাগ্যশালী বৃক্ষরাজির দিকে
যারা কেবলমাত্র অন্যের কল্যানহেতু জীবনধারণ করে !
আমাদের রক্ষা করে
ঝড়, বৃষ্টি, তাপ ও তুষার হতে।
অহো এষাং বরং জন্ম
সর্বপ্রাণ্যুপজীবনম্।
সুজনস্যেব য়েষাং বৈ
বিমুখা যান্তি নার্থিনঃ॥৩৩
মহৎ মনুষ্যের ন্যায় মহৎ এই বৃক্ষরাজির জন্ম
যা সকল প্রাণীর অবলম্বন।
কোনও সাহায্যপ্রার্থীকেই
তারা হতাশ করেনা।
পত্রপুষ্পফলচ্ছাযা-
মূলবল্কলদারুভিঃ।
গন্ধনির্যাসভস্মাস্থি-
তোক্মৈঃ কামান্ বিতন্বতে॥৩৪
পত্র, পুষ্প, ফল, ছায়া,
মূল, বল্কল, কাষ্ঠ, সুবাস,
নির্যাস, ভস্ম, কাষ্ঠমণ্ড ও কাণ্ড -
আমরা যা চাই বৃক্ষ তাই দেয়।
এতাবজ্জন্মসাফল্যং
দেহিনাম্ ইহ দেহিষু।
প্রাণৈরর্থৈর্ধিযা বাচা
শ্রেয় আচরণং সদা॥৩৫
আমাদের জীবন, সম্পদ, বুদ্ধি ও বচন
সদাই সর্বকল্যাণে ব্যবহৃত হওয়া উচিত।
তবেই আমাদের জীবন হবে সার্থক।
এমনকি সেই নিতান্ত অল্পবয়সেও তিনি উদার জীবনযাপনের এক খুবই সহজ অথচ শক্তিশালী বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। গীতায় ব্রহ্মণ্ সম্পর্কে (ভ.গী. ১৩.১২-১৭) উনি যা বলছেন, তার সাথে আমরা এই ঘটনা মিলিয়ে নিতে পারি। সেখানে তিনি তাঁর সেই অষ্টমবর্ষীয় বালকাবস্থার সহজসরল কথাগুলির একটি অত্যাধুনিক ব্যাখা উপস্থাপিত করছেন।
তাঁর জন্মের ঠিক পরেই, পিতা বসুদেব তাঁকে গোকুলে নিয়ে আসেন এবং নন্দগোপের কাছে রেখে যান। যখন অক্রূরের মাধ্যমে ত্রয়োদশবর্ষীয় কৃষ্ণের কাছে কংসের বার্তা (ভা.পু. ১০.৩৮–৪৪। এই অংশে কৃষ্ণের গোকুল থেকে মথুরায় যাত্রা বর্ণিত আছে) এসে পৌঁছয়, তখন তিনি অক্রূরের কাছে নিজের জন্মবৃত্তান্ত জানতে পারেন। কিশোর কৃষ্ণের কিন্তু তাঁর কারাগারে বন্দি ক্লান্ত অবসন্ন মাতা-পিতার কথা ভেবে কোনও অনুশোচনা হয়না বা ‘আসল’ মাতা-পিতার পরিচয় জেনে কোনও অযৌক্তিক আনন্দও হয়না। পালক মাতা-পিতার প্রতি তাঁর ভালবাসার বিন্দুমাত্র ও পরিবর্তন হয়না। কৃষ্ণ তাঁর জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা পিতাকে অত্যন্ত ভালবাসলেও কখনও পালক মাতা-পিতার প্রতি তাঁর ভালবাসার পরিবর্তন হয়নি। সেভাবে দেখতে গেলে, সমস্ত গোকুলবাসীই কৃষ্ণকে নিজসন্তান রূপেই দেখতেন।
কর্ণের ক্ষেত্রে, তাঁর জন্মদাত্রী মায়ের পরিচয় পাওয়ার সাথে এই ঘটনার বৈষম্য লক্ষ্য করুন। নিজে সূতপুত্র হওয়ার কারণে কর্ণ চিরকাল আক্ষেপ করে গিয়েছেন এবং যখন তাঁর বয়স ষাঠের ঘরে, তখন তিনি নিজের জন্মদাত্রী মায়ের পরিচয় জেনেছেন। তবুও, পালক মাতা-পিতা ও কুন্তির মাঝে পড়ে তাঁর মনের টানাপড়েন চলেছে। কর্ণ উভয়সঙ্কটে পড়েছিলেন - তাঁর কি দুর্যোধনকে ত্যাগ করা উচিত, নাকি পাণ্ডবদের প্রতি রক্তের টান অগ্রাহ্য করা উচিত। তিনি এতে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন।
আবার কৃষ্ণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তিনি কখনও অতীত নিয়ে বিলাপ করেননি। তিনি ছিলেন এক রাজপুত্র, যিনি গোপালকদের মধ্যে বড় হয়েছিলেন। তিনি কখনও তা নিয়ে আক্ষেপ করেননি। যে অবস্থায় ছিলেন সেই অবস্থায় যতটা ভাল সম্ভব, করেছেন। ভাল-মন্দ সকল অবস্থার চোখে চোখ রেখে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। তিনি ঘৃণাও করেন না, প্রশ্রয়ও দেননা, আবার উদ্বিগ্নও হননা, অভিযোগও করেননা। তিনি অবিচলিত, নিরপেক্ষ। ভাল ও মন্দের প্রতি তাঁর সমান দৃষ্টি। এই সমস্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে গীতায় তাঁকে গুণকীর্তন করতে দেখা যায় (ভ. গী. ২.৫৭, ১২.১৭, ১৪.২৪- ২৫)।
ক্রমশ:
মূলরচনা - শতাবধানী ডঃ আর. গণেশ ও হরি রবিকুমারের “ভগবদ-গীতা ইন দ্য লাইফ অফ কৃষ্ণ”
তথ্যসূত্র
ভাগবতপুরাণ (গোরখপুর: গীতা প্রেস)
মহাভারত এবং হরিবংশের (ক্রিটিকল টেক্স্ট) জটিল সংস্করণ / সমালোচনামূলক সংস্করণ (৫ খণ্ডে). সম্পাদনা - ভি. এস. সুখথংকর ও অন্যান্য (পুনে, ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সিটিউট – ১৯৬৬)
দ্য নিউ ভগবদ্গীতা - কোটি শ্রীকৃষ্ণ এবং হরি রবিকুমার (মেসন: ডব্লিউ. আই. এস. ই. ওয়র্ডস্ ২০১১)