গীতায় কৃষ্ণ একজন “স্থিতপ্রজ্ঞ” ব্যক্তি হয়ে ওঠার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণার অবতারণা করেছেন, অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি যিনি বিচার-বিবেচনাপূর্ণ এবং অবিচলিত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। তিনি বলেন, “যিনি স্বার্থপরতা বর্জন করে শুধুমাত্র সত্যের স্বরূপেই পরিতৃপ্তি লাভ করেন, তিনিই ‘স্থিতপ্রজ্ঞ’ “(ভ. গী. ২.৫৫)। অন্যভাবে বলা যায়, তিনি অর্জুনকে ‘দেহাভিমান’ ত্যাগ করতে বলছেন, যার অর্থ সেইপ্রকার মনোভাব, যখন জীবনের প্রতি নিবদ্ধ দৃষ্টি একরকম দেহ ও বস্তুভিত্তিক ঘোরের মধ্যে থাকে।
কৃষ্ণ সারাজীবনই ‘ স্থিতপ্রজ্ঞ’ হয়ে থেকেছেন। তাঁর না ছিল কোনও অনুশোচনা না কোনও অভিযোগ। তিনি যেমন কোনও কার্যসাধন করতে পেরে কখনও পরমোল্লসিত বোধ করেননি, তেমনই করতে না পেরেও কখনও অনুশোচনা বোধ করেননি। তাঁর অন্তর-ই ছিল পরিতৃপ্ত। অর্জুন যখন কৃষ্ণের কাছে বিলাপ করেছেন যে মন বড় অস্থির এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখা ততোধিক কঠিন (ভ. গী. ৬.৩৪), কৃষ্ণ উত্তরে বলেছেন, “নিঃসন্দেহে মনকে নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ, কিন্তু অভ্যাস এবং বৈরাগ্যের দ্বারা তুমি তা করতে সক্ষম হবে” (ভ. গী. ৬.৩৫)। কৃষ্ণ স্বয়ং এই দুই বৈশিষ্ট্যের-ই অধিকারী। তিনি সর্বদা বর্তমান নিয়ে বাঁচেন। তিনি যতটা সম্ভব হয় শেখেন। তিনি যতটা সম্ভব হয় মুক্ত করেন।
উপরন্তু, অর্জুনকে কৃষ্ণের এই উত্তরপ্রদান বিশেষভাবে শিক্ষামূলক ও বটে। কৃষ্ণ এমন এক ব্যক্তি যিনি বৃথা আশ্বাস দেননা, যা সত্য তা-ই বলেন, কিন্তু তাঁর শব্দচয়ন অত্যন্ত বিনীত ও নম্র। তিনি যে আশাব্যঞ্জক ভাবে সমস্যার বাস্তব সমাধান দেন তা নয়, বরং তিনি একইসঙ্গে বিষয়গত ও উৎসাহদায়ক।
কৃষ্ণ তাঁর জীবনে ভীতি, অসূয়া, অস্থিরতা এবং উদ্দামোল্লাস থেকে মুক্ত ছিলেন এবং গীতায়ও তিনি সেই একই কথাই বলেছেন (ভ. গী. ১২.১৫)। কৃষ্ণের মধ্যে কখনও অস্থিরতা বা উৎকণ্ঠার চিহ্নমাত্র দেখা যায়নি। এমনকি, সমগ্র যদুবংশ যখন পরস্পরকে হত্যা করতে যুদ্ধে রত, তখনও তিনি বিচলিত বোধ করেননি। তাঁর আপনজনেরাই যখন পরস্পরকে নাশ করছে, তিনি নিঃশব্দে তা প্রত্যক্ষ করেছেন। পরিশেষে, তিনি এগিয়ে এসে যারা এরপর অবশিষ্ট ছিল তাদের বধ করেছেন (ম. ভা. ১৬.১-৯, ভা. পু. ১১.৩০)। এইভাবে তিনি গান্ধারীর প্রতি তাঁর প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করেছেন। তিনি সর্বদা বর্তমান নিয়ে বেঁচেছেন এবং সেকারণেই তাঁর জীবনে ব্যর্থতাও বিরল। একভাবে দেখতে গেলে, শত্রু বা মিত্র, ঋষি বা পাপী, আত্মীয় বা অনাত্মীয় – সকলের প্রতিই তাঁর সমান সমবেদনা ও আন্তরিকতা ছিল (ভ. গী. ৬.৯)।
কৃষ্ণ জানেন যে, দৈহিক সত্ত্বা হল আংশিক সত্য। যে কারণেই তিনি বলেন, “জন্মের পূর্বে ও মৃত্যুর পরে সকলেই নিরাকার; এই দুইয়ের মাঝেই সকলে আকার ধারণ করে” (ভ. গী. ২.২৮)। তিনি বলেন, জন্ম ও মৃত্যু অনিবার্য। যদিও মনে রাখা দরকার যে, জীবন মূল্যবান এবং এও সত্য যে আত্মা অবিনশ্বর ও চিরন্তন। অন্যভাবে বলতে গেলে, জন্ম বা মৃত্যু নিয়ে শোক না করে, জীবনকে সর্বান্তকরণে গ্রহণ করাই শ্রেয় (ভ. গী. ২.২৭)।
জন্ম বা মৃত্যু আমাদের হাতে নেই – যেটা মূল্যবান সেটা হল জীবন এবং এই জীবনই একমাত্র আছে আমাদের হাতে। (এমনকি আত্মহত্যার মত বিরল ঘটনাগুলিও কখনও কোনও আনন্দ বা যুক্তির বশবর্তী হয়ে ঘটেনা, বরং ঘটে জীবনের প্রতি চরম বিতৃষ্ণা বা পরজন্ম সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণার কারণে)। কৃষ্ণ জীবনকে ভালবাসেন এবং অর্জুনকেও সেই বার্তাই দিয়েছেন। সেই কারণে, যদি অর্জুন উদাসীন হয়ে যুদ্ধ ত্যাগ করে কোনও আনন্দ লাভ করতেন, কৃষ্ণ হয়ত বাধা দিতেন না। আবার, বলরামের মত অর্জুনও যদি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতেন যে তিনি যুদ্ধ থেকে দূরেই থাকতে চান, কৃষ্ণ হয়ত তাতেও আপত্তি করতেননা। কিন্তু অর্জুন ছিলেন ক্রন্দনরত, ব্যথিত, ভাবাবেগে বাহিত এবং বিভ্রান্ত। অর্জুন কৃষ্ণের কাছে উপদেশ প্রার্থনা করেছিলেন। সেকারণেই কৃষ্ণ তাঁকে সান্ত্বনাপ্রদান করেন ও তাঁর পথপ্রদর্শক রূপে অবতীর্ণ হন।
কৃষ্ণের কখনও মৃত্যুভয় ছিলনা এবং তিনি পরিপূর্ণতার সাথেই জীবন অতিবাহিত করেছেন। তাঁর জন্ম এক অঘটন। মধ্যরাত্রে এক কারাগারে তাঁর জন্ম। তাঁর মৃত্যুও এক অঘটন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে কোনও নায়কোচিত মৃত্যুবরণ করেননি বা ভয়ঙ্কর ব্যধির সঙ্গে সংগ্রাম করেও দেহত্যাগ করেননি। অতি সাধারণ এক ব্যাধের এক বিপথগামী শরের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয় (ম. ভা. ১৬.১-৯)। বাতাসে ভেসে আসা সুরভির মত তিনি কোথাও যেন মিলিয়ে যান।
(ক্রমশ:)
মূলরচনা - শতাবধানী ডঃ আর. গণেশ ও হরি রবিকুমারের “ভগবদ-গীতা ইন দ্য লাইফ অফ কৃষ্ণ”
তথ্যসূত্র
ভাগবতপুরাণ (গোরখপুর: গীতা প্রেস)
মহাভারত এবং হরিবংশের (ক্রিটিকাল টেক্স্ট) জটিল সংস্করণ / সমালোচনামূলক সংস্করণ (৫ খণ্ডে). সম্পাদনা - ভি. এস. সুখথংকর ও অন্যান্য (পুনে, ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সিটিউট – ১৯৬৬)
দ্য নিউ ভগবদ্গীতা - কোটি শ্রীকৃষ্ণ এবং হরি রবিকুমার (মেসন: ডব্লিউ. আই. এস. ই. ওয়র্ডস্ ২০১১)