গীতায় কৃষ্ণ শান্তিলাভ করার নিমিত্ত এক অশ্রুতপূর্ব সূত্র প্রদান করেন। তিনি বলেন যে, যখন কোনও ব্যক্তি কামনার ঊর্দ্ধে গিয়ে, আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ ক’রে, অহং এবং অধিকারবোধ বর্জন ক’রে জীবন অতিবাহিত করেন, তখনই সেই ব্যক্তি প্রকৃত শান্তিলাভ করেন (ভ. গী. ২.৭১)। কৃষ্ণ নিজজীবনে শান্তিলাভের জন্য অবিকল এই পন্থাই অনুসরণ করেছেন।
কৃষ্ণ ব্যক্তিগত লাভ, কামনা ও আকাঙ্ক্ষা বর্জিত এক জীবন কাটিয়েছেন। কখনও কোনও বস্তুবিশেষ, ক্ষমতা, পদ বা খ্যাতির অন্বেষণ করেননি। কখনও লাভের আশায় যুদ্ধ করেননি। কখনও রাজ্য, গৃহ বা সম্পত্তি লাভ করার আকাঙ্ক্ষা রাখেননি। এগুলি আপনা থেকেই তাঁর কাছে এসেছে। তিনি কখনও কোনও নারীর অনুধাবন করেননি, তারাই কৃষ্ণের নিকটে এসেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, কৃষ্ণ দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে অংশগ্রহন করার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তিনি নিমন্ত্রন রক্ষা করতে এলেও অংশগ্রহন করেননি। তিনি নিজে অর্জুন বা কর্ণের চেয়ে অধিক বলশালী হলেও শুধুমাত্র দর্শকাসনে বসা থাকাই স্থির করেন। এবং সঠিক সময় এলে পর, ধর্মরক্ষার্থে উঠে দাঁড়ান (ম.ভা. ১.১৭৭-১৮১)।
ভাগবতপুরাণে অতিদুর্লভ ও অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতাসম্পন্ন স্যামন্তক মণিকে (খুব সম্ভবত চুনি) আবর্তন ক’রে একটি সুন্দর উপাখ্যান রচিত আছে (ভা.পু. ১০.৫৬-৫৭)। যাদবগোষ্ঠীর প্রধান পুরুষ সত্রাজিতের কাছে এই স্যামন্তক মণিটি ছিল। মানবকল্যাণের উদ্দেশ্য নিয়ে কৃষ্ণ সত্রাজিতের কাছে মণিটি চেয়েছিলেন (এটি খুব সম্ভবত গীতায় কৃষ্ণের একটি বিখ্যাত বিবৃতির ব্যাখা (ভ. গী. ৭.১১) - ‘আমিই সেই কামনা যা ধর্মকে লঙ্ঘন করেনা’)।
সত্রাজিত অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবেই প্রত্যাখ্যান করেন। কৃষ্ণও এই নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য না করে বাড়ি ফিরে যান। তিনি এই মণি লাভ করার জন্য কোনও কৌশল অবলম্বনের চেষ্টা করেননি। তিনি অত্যন্ত সুদক্ষ কৌশলী হয়েও কখনও ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি।
এরপর একদিন, মণিটি উধাও হয় এবং সত্রাজিতের ভাই প্রসেন, যিনি এই মণি পরিধান করতেন, তাঁকে মৃত রূপে পাওয়া যায়। কৃষ্ণকে চুরি এবং হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। তিনি অবিলম্বে ঘোষণা করেন যে, মণি খুঁজে আনতে না পারলে তিনি আর নগরে প্রবেশ করবেননা। তারপর তিনি একজন দক্ষ গোয়েন্দার মত অনুসন্ধান চালিয়ে পরিশেষে জাম্ববানের কাছে মণিটি আবিষ্কার করেন। তিনি সেই মণি উদ্ধার ক’রে সত্রাজিতকে ফিরিয়ে দেন। তিনি মণিটির মূল্য নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে মণির আসল স্বত্বাধিকারীর হাতে তুলে দেন। অনেক পরে, অক্রূরের হাতে স্যামন্তক মণিটি গিয়ে পড়ে। বেশীরভাগ মানুষ, এমনকি বলরামেরও সন্দেহ ছিল যে মণিটি কৃষ্ণের কাছেই আছে। পুনরায় নিজেকে কালিমামুক্ত করতে কৃষ্ণ অক্রূরের কাছে যান এবং তাঁকে মণিটি বার করে সকলকে দেখাতে বলেন।
এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যায় যেখানে আমরা কৃষ্ণকে এমন এক ব্যক্তিরূপে দেখতে পাই যিনি চান যে কর্ম যেন সম্পন্ন হয়। সেই কর্ম তিনি নিজে সম্পন্ন করলেন বা অন্য কেউ সম্পন্ন করল, সেই নিয়ে তিনি কখনও বিব্রত বোধ করেননা। তিনি প্রকৃতই সেই ব্যক্তি যিনি শুভ ও অশুভ উভয়কেই পরিত্যাগ করেছেন (ভ. গী. ১২.১৭)। তিনি গীতায় একজন প্রকৃত ভক্তের যে বিবরণ দেন, নিজেও ঠিক সেই পথেই জীবন অতিবাহিত করেন – তাঁর শান্তি কারও দ্বারা বিঘ্নিত হয়না, আবার তিনি সকলের সাথেই শান্তিতে অবস্থান করেন (ভ. গী. ১২.১৫)।
মহাভারতে, কৃষ্ণের শান্তিপ্রস্তাব নিয়ে আসার পূর্বে, তিনি এক পরিকল্পনার কথা বলেন যাতে পাণ্ডব ও কৌরবেরা সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান করতে পারেন। তিনি বলেন যে, উভয়পক্ষেরই ধর্ম এবং উদারতা নিয়ে বাঁচা উচিৎ (ম.ভা. ৫.১)। এমনকি কৌরবেরা দোষী হলেও কৃষ্ণের মুখে শান্তির বাণীই শোনা যায় (ম.ভা. ৫.২)। কৃষ্ণ বলেন যে, যতই হোক, পাণ্ডব ও কৌরব পরস্পরের আত্মীয়; কোনও পক্ষেরই রক্তক্ষয় কেন হবে? এরপর তিনি দ্রুপদকে সভা পরিচালনার দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন (ম.ভা. ৫.৫)।
শান্তিদৌত্য চলাকালীন, যখন কৃষ্ণ বিদুরের গৃহে অবস্থান করছেন, সেদিন তাঁদের দুজনের মধ্যে গভীর রাত্রি পর্যন্ত দীর্ঘ আলোচনা চলে। আলোচনা চলাকালীন কৃষ্ণ বিদুরকে বলেন যে, তিনি সত্যই শান্তি চান। তিনি বলেন, “যদি কোনও ব্যক্তির কল্যাণসাধনের ক্ষমতা থাকে, তবে তাঁর সেই ক্ষমতা ব্যবহার করা উচিৎ। আমি শান্তিরক্ষার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। এবং তাই যদি হয়, আমি কোনও এক শুভকার্য সম্পন্ন হয়েছে বলে পরিতুষ্ট হব এবং কৌরবরাও রক্ষা পাবে (ম.ভা. ৫.৯০-৯১)।
ক্রমশ:
মূলরচনা - শতাবধানী ডঃ আর. গণেশ ও হরি রবিকুমারের “ভগবদ-গীতা ইন দ্য লাইফ অফ কৃষ্ণ”
তথ্যসূত্র
ভাগবতপুরাণ (গোরখপুর: গীতা প্রেস)
মহাভারত এবং হরিবংশের (ক্রিটিকাল টেক্স্ট) জটিল সংস্করণ / সমালোচনামূলক সংস্করণ (৫ খণ্ডে). সম্পাদনা - ভি. এস. সুখথংকর ও অন্যান্য (পুনে, ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সিটিউট – ১৯৬৬)
দ্য নিউ ভগবদ্গীতা - কোটি শ্রীকৃষ্ণ এবং হরি রবিকুমার (মেসন: ডব্লিউ. আই. এস. ই. ওয়র্ডস্ ২০১১)