কৃষ্ণের জীবনের প্রারম্ভে তেমন প্রাচুর্য না থাকার কারণেই সম্ভবত তিনি অনাড়ম্বর জীবনেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। যদিও পরবর্তীকালের পণ্ডিতদের কল্পনায় কৃষ্ণের পরিহিত বহুমূল্য বস্ত্রাদির উল্লেখ পাওয়া যায়, কিন্তু প্রাচীন গ্রন্থগুলি থেকে তেমন কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায়না। তাঁর বস্ত্রের বর্ণ ছিল হলুদ (পীতাম্বর), খুব সম্ভবত তাঁর কৃষ্ণ গাত্রবর্ণের সঙ্গে মানানসই হত বলে। তাঁর ভূষণ ছিল যৎসামান্য। তিনি বনপুষ্পমাল্যে ও মৌরমুকুটে সুশোভিত হতেই পছন্দ করতেন।
গীতায় কৃষ্ণ একজন আদর্শ ভক্তের বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিবরণ দেবার সময়, একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেন যাকে বলে ‘অনিকেত’। এই শব্দের অর্থ ‘গৃহহীন’ হলেও, এখানে সেই ব্যক্তিকে বোঝায় যার কাছে আপন গৃহ বিব্রত। যিনি কোনও একটি স্থানকে গৃহ মনে না করে, সর্বত্রই গৃহসুখ অনুভব করে থাকেন (ভ. গী. ১২.১৯)। কৃষ্ণের ক্ষেত্রেও এই শব্দ প্রযোজ্য। তিনি কোনও বিশেষ একটি স্থানকে কখনও আপন বাসস্থান রূপে ভাবতে পারেননি- চিরকালই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানপরিবর্তন করে গেছেন। জন্মের পর থেকে কৈশোর জীবনের প্রথম কয়েকটি বছর পর্যন্ত গোকুলেই তাঁর বাস ছিল, তারপর থেকে তাঁর জীবনযাপন যাযাবরের মত। যাদবদের জন্য তিনি বিরাট দ্বারকাপুরী নির্মাণ করলেও, তিনি নিজে খুব অল্প সময়ের জন্যেই সেখানে বসবাস করেছেন। যখন তিনি অর্জুনের সারথি ছিলেন, বেশীরভাগ সময় তিনি রথেই কাটিয়েছেন (এবং যখন তিনি রথ থেকে শেষবারের মত নেমে আসেন, রথটি ভস্মীভূত হয়)। এক অর্থে, তাঁর এই সারথ্য জীবন তাঁর গতিময়তার প্রতীক।
একজন ভক্তের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলি কৃষ্ণ যা উল্লেখ করেছেন সেগুলি হল – সন্তুষ্টঃ সততম্ যোগী (১২.১৪), অনপেক্ষঃ (১২.১৬), সন্তুষ্টয়েন কেনাচিত (১২.১৯) – এইসব বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যেই সন্তুষ্টি প্রাধান্য পায়। কৃষ্ণ ছিলেন আত্মতৃপ্তির অপর নাম। যখন তিনি দ্বৈতবনে পাণ্ডবদের সাথে দেখা করেতে গেলেন, দ্রৌপদীর অক্ষয়পাত্রে অবশিষ্ট একটি ভাতের দানা খেয়েই তিনি পরম তৃপ্তি লাভ করলেন (মহাভারতের ক্রিটিকাল টেক্স্ট/জটিল সংস্করণে এই ঘটনার উল্লেখ না থাকলেও গোরখপুর সংস্করণে পাওয়া যায়)।
গীতায় কৃষ্ণ বলেন যে, হোক না তাহা সামান্য পত্র, পুষ্প,ফল অথবা শুধু জল, স্নেহবশে প্রদত্ত যেকোনো কিছু পেয়েই তিনি পরমসুখ লাভ করেন (ভ. গী. ৯.২৬)। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে মনে করুন, মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে হস্তিনাপুরে শান্তির প্রস্তাব নিয়ে কৃষ্ণের আগমন (ম.ভা. ৫.৭০–১৩৭ অধ্যায় জুড়ে এই ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়)। রাজকীয় ভোজনোৎসব এবং দুর্যোধনের বিলাসবহুল গৃহে অবস্থানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি গিয়ে উঠলেন বিদুরের দীনকুটিরে, গ্রহণ করলেন অতিসামান্য আহার। আসলে, কৃষ্ণের আসন্ন আগমনের কথা জানতে পেরে ধৃতরাষ্ট্র তাঁর সভায় এই প্রস্তাব করেছিলেন যে, কৃষ্ণকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে বহুমুল্যবান উপহার দিয়ে স্বাগত জানান হোক। তখন বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বলেন যে, এই সমস্ত সম্মান বা উপহারসামগ্রী দিয়ে কৃষ্ণকে প্রভাবিত করা সম্ভব নয়, কারণ তিনি এইসকল নিম্নমনস্কতার ঊর্দ্ধে। বিদুর বলেন, “আপনি যদি সত্যই কৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করতে চান এবং তাঁর হৃদয়জয় করতে ইচ্ছা করেন, তাহলে শান্তির প্রস্তাবে সম্মত হন এবং যুদ্ধকে দূরে ঠেলে ভ্রাতৃগণের মধ্যে এক বিরাট পুনর্মিলনের ব্যবস্থা করুন।”
গীতায় কৃষ্ণ কঠোর শারীরিক সংযমের কথা বলেছেন। সারল্য, আত্মসংযম, বিশুদ্ধতা, পরার্থপরতা এবং ঈশ্বর, পণ্ডিত, শিক্ষক ও প্রকৃত জ্ঞানীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াও এর অন্তর্ভুক্ত। তিনি আজীবন এই পথ অনুসরণ করেছেন, ধনসম্পদ সঞ্চয় অথবা ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার চিন্তাকে নিজমনে কদাচিৎ প্রবেশাধিকার দেননি। তিনি নিজের পারিপার্শ্বিক সকল সত্ত্বার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং সকল সত্ত্বার কাছে নিজে পরম শ্রদ্ধায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
ক্রমশ:
মূলরচনা - শতাবধানী ডঃ আর. গণেশ ও হরি রবিকুমারের “ভগবদ-গীতা ইন দ্য লাইফ অফ কৃষ্ণ”
তথ্যসূত্র
ভাগবতপুরাণ (গোরখপুর: গীতা প্রেস)
মহাভারত এবং হরিবংশের (ক্রিটিকাল টেক্স্ট) জটিল সংস্করণ / সমালোচনামূলক সংস্করণ (৫ খণ্ডে). সম্পাদনা - ভি. এস. সুখথংকর ও অন্যান্য (পুনে, ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সিটিউট – ১৯৬৬)
দ্য নিউ ভগবদ্গীতা - কোটি শ্রীকৃষ্ণ এবং হরি রবিকুমার (মেসন: ডব্লিউ. আই. এস. ই. ওয়র্ডস্ ২০১১)