গোপালকদের মাঝে বেড়ে ওঠা কৃষ্ণ ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন ভূমিপুত্র। শিশুকাল থেকেই যেন প্রকৃতির সাথে তাঁর আত্মিক যোগ। শৈশবেই তিনি প্রাকৃতিক পরিবেশকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছিলেন। ভাগবত পুরাণের একটি অধ্যায়ে তাঁকে একটি সুপ্রাচীন বটবৃক্ষের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে দেখা যায় (ভা.পু. ১০.২২)। বৃক্ষ, গাভী ও মানুষের প্রতি কৃষ্ণকে সশ্রদ্ধ হতে দেখা যায়। সশ্রদ্ধ হতে দেখা যায় সমগ্র সৃষ্টির প্রতি। এমনকি, যুদ্ধে পরাজিত করার পরেও তিনি কালিয়ানাগকে বধ করেননি, বরং পুনর্বাসিত করেন (ভা.পু. ১০.১৬-১৭)। তাঁর বংশীবাদনের দক্ষতাও এমনই উৎকর্ষের মাত্রা ছাড়িয়েছিল যে, সেই সুরের মূর্ছনায় শ্রোতারা কোথায় যেন হারিয়ে যেত। তাঁর সহজ সাবলীল সামাজিক জীবন, সকলের সাথে একাত্ম হয়ে সকলকে বড় সুখী ক’রে তুলত। তিনি গোপীগণের সাথে নাচেগানে মেতে থাকলেও, তাঁর অন্তরে ছিল এক গভীর চিন্তাশীল এবং অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। তাঁর কৈশোরাবস্থার শেষদিকে যথাবিধি শিক্ষালাভের সুযোগ আসে। মহর্ষি সান্দীপনির নিকট শিক্ষালাভ করতে তিনি মথুরা থেকে উজ্জয়িনী ছুটে আসেন (ভা.পু. ১০.৪৫)। তাঁর সহপাঠীরা বয়সে তাঁর চেয়ে অনেকটা ছোট হ’লেও, সেটা কখনও তাঁর লজ্জার কারণ হয়ে ওঠেনি। বরং, তিনি তাঁর সহপাঠীদের কাছে এক পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছিলেন। গীতায় তিনি বলেন যে, মানুষের এমনই গুরুর কাছে শিক্ষালাভ করা উচিত যিনি সত্যকে উপলব্ধি করেছেন, এবং গুরুর কাছে আন্তরিক জিজ্ঞাসা এবং নম্রতা নিয়ে সেবায় উপস্থিত হওয়া উচিত (ভ.গী. ৪.৩৪)। যখন তিনি মহর্ষি সান্দীপনির গুরুকুলে আসেন তখন তিনি নিজেও ঠিক তাই করেছিলেন। কৃষ্ণ অতি শীঘ্রই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসাবে পরিগণিত হলেন। তিনি নিজে জ্ঞানের কদর করতেন এবং গীতায় তাঁকে এর উপর গুরুত্ব আরোপ করতেও দেখা যায় (ভ.গী. ৪.৩৮-৩৯)।
পরবর্তীকালে, কৃষ্ণ যান ঋষি ঘোর আঙ্গিরসের কাছে যোগ ও দর্শনশাস্ত্র শিখতে (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩.১৭.৬)। তিনি ক্ষুধাতৃষ্ণা কে পরাভূত করার বিদ্যা লাভ করেন। অন্যভাবে বলা যায়, তিনি শরীরের ঊর্ধ্বে চলে যান।
গীতায় যোগীদের প্রসঙ্গ উঠলে, কৃষ্ণ বলেন প্রকৃত যোগী তিনিই, যিনি সকল ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করেছেন এবং যিনি একনিষ্ঠ ভাবে যোগসাধনা করে থাকেন (ভ. গী. ৫.৭)।
পরে তিনি এও বলেন যে, অনন্তের সাথে একাত্ম হতে চায় যে ব্যাক্তি, সেই ব্যাক্তি আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করে থাকেন (ভ. গী. ৮.১১)। ব্রহ্মচর্য বা ব্রহ্মণ্ পথ হল, তুচ্ছ ঘটনা থেকে মনকে দূরে সরিয়ে রেখে এক পবিত্র জীবন যাপন করা। এই পথে যিনি চলেন, তিনিই ব্রহ্মচারী।
মহাভারতে বর্ণিত আছে, যখন অশ্বত্থামা “নিষ্পাণ্ডবামস্তু” (পাণ্ডবগণের বিনাশ হোক) মন্ত্র উচ্চারণ করে ব্রহ্মশিরাস্ত্র নিক্ষেপ করেন এবং অবশেষে অস্ত্রটি উত্তরার গর্ভ অভিমুখে ধাবিত হয়, তখন কৃষ্ণ বলেন, “যদি আমি ব্রহ্মচারী হই, এই শিশুটি যেন বেঁচে থাকে। যদি আমি সৎ হই, যদি জীবনে কখনও পরিহাস ছলেও মিথ্যাচার না করে থাকি, এবং যদি আমি কখনও যুদ্ধ থেকে পালিয়ে গিয়ে না থাকি, এই শিশুটি যেন বেঁচে থাকে (ম.ভা. ১৪.৬৮)। এবং উত্তরার সন্তানের প্রাণরক্ষা হয়। এই ঘটনাটিকে তাঁর সত্তার উপর দখল ও আত্মসংযমের প্রতীক হিসেবে ভাবা যেতে পারে।
বছরের পর বছর ধরে তিনি নানান দক্ষতা অর্জন করেন। বাগ্মিতায় তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিলনা। তিনি ছিলেন এক মহান কূটনীতিজ্ঞ, এক প্ররোচক মধ্যস্থতাকারী এবং এক সম্পূর্ণ কৌশলী। এমনকি, অমূল্য স্যামন্তক মণি উদ্ধার করার সময় তাঁর ক্ষুরধার অনুসন্ধানী বুদ্ধিরও প্রমাণ পাওয়া যায় (ভা.পু. ১০.৫৬-৫৭)। যুদ্ধ রুখতে তিনি যতদূর সম্ভব চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু যুদ্ধ যখন সামনে, তখন লড়তে পিছপা হননি। তিনি ছিলেন এক অপরাজেয় যোদ্ধা, যিনি নিজে হাতে অনেক যোদ্ধাকে প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে সর্বদা মনে রাখা হয় তাঁর স্মিতহাস্য ও আত্মজ্ঞানের অপরিসিমতায়। নিঃসন্দেহে, তিনি আমাদের ঐতিহ্যের অতিপ্রাচীন সর্বজ্ঞদের একজন।
ক্রমশ:
মূলরচনা - শতাবধানী ডঃ আর. গণেশ ও হরি রবিকুমারের “ভগবদ-গীতা ইন দ্য লাইফ অফ কৃষ্ণ”
তথ্যসূত্র
ভাগবতপুরাণ (গোরখপুর: গীতা প্রেস)
মহাভারত এবং হরিবংশের (ক্রিটিকাল টেক্স্ট) জটিল সংস্করণ / সমালোচনামূলক সংস্করণ (৫ খণ্ডে). সম্পাদনা - ভি. এস. সুখথংকর ও অন্যান্য (পুনে, ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সিটিউট – ১৯৬৬)
দ্য নিউ ভগবদ্গীতা - কোটি শ্রীকৃষ্ণ এবং হরি রবিকুমার (মেসন: ডব্লিউ. আই. এস. ই. ওয়র্ডস্ ২০১১)